ইখ্লাছ ব্যতীত আমলের কোন মূল্যই আল্লাহ পাক উনার নিকট নেই। তাই বলা হয়ে থাকে যে, ইলম বা ইসলাম হলো একটি পাখি, আমল হলো তার পাখা, আর ইখ্লাছ হলো তার রূহ্। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
فالناس كلهم هلكى الا العالمون والعالمون كلهم هلكى الا العاملون والعاملون كلهم هلكى الا المخلصون والمخلصون على خطر عظيم. অর্থ:- “সকল মানুষ ধ্বংস প্রাপ্ত, একমাত্র আলেমগণ ব্যতীত। আলেমগণও ধ্বংস প্রাপ্ত, একমাত্র আমলকারীগণ ব্যতীত। আমলকারীগণও ধ্বংস প্রাপ্ত, একমাত্র
ইখ্লাছের সাথে আমলকারীগণ ব্যতীত। আর মুখ্িলছ বান্দাগণও মহা চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।”
কিতাবের উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ঈমানদারদের জন্যে ইখ্লাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার কারণে মহান আল্লাহ পাক, রাব্বুল আ’লামীন কুরআনশরীফ-উনার অসংখ্য স্থানে এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্য হাদীছ শরীফে ইখ্লাছ অর্জনের ব্যাপারে তাকীদ করেছেন। যেমন আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,
وما امروا الا ليعدوا الله مخلصين له الدين.
অর্থ:- “আমি তাদেরকে শুধুমাত্র ইখ্লাছের সাথে ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছি।” (সূরা আল বাইয়্যিনাহ্/৫)
আর হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, يامعاذ اخلص دينك يكفيك العمل القليل.
অর্থ:- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে মু’য়াজ, তোমার দ্বীন বা আমলের মধ্যে ইখ্লাছ পয়দা কর, তবে তোমার জন্যে অল্প আমলই যথেষ্ট।” (তারগীব)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইখ্লাছ ছাড়া আমলের কোন মূল্যই আল্লাহ পাক উনার নিকট নেই। আর ইখ্লাছের সাথে অল্প আমলই আল্লাহ পাক উনার রেজামন্দী বা সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অপরদিকে ইখ্লাছ বিহীন পাহাড় পরিমাণ আমলের দ্বারাও আল্লাহ পাক উনার হাক্বীক্বী রেজামন্দী হাছিল করা সম্ভব নয়।
ইখ্লাছের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে যে,
عن ابى هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان اول الناس يقض عليه يوم القيامة رجل استشهد فاتى به فعرفه نعمته فعرفها فقال فماعملت فيها؟ قال قاتلت فيك حتى استشهدت، قال كذبت- ولكنك قاتلت لان يقال جرىء فقد قيل ثم امربه فسحب على وجهه حتى القىفى النار- ورجل تعلم العلم وعلمه وقرأ القران فاتىبه فعرفه نعمه- فعرفها قال فما عملت فيها؟ قال تعلمت العلم وعلمته وقرأت فيك القران- قال كذبت ولكنك تعلمت العلم ليقال انك عالم-
وقرأت القران ليقال انك قارىء- فقد قيل- ثم امربه فسحب على وجهه حتى القى فى النار- ورجل وسح الله عليه- واعطاه من اصناف المال كله- فاتى به فعرفه نعمه فعر فها- قال فما عملت فيها؟ قال ماتر كت من سببل تحب ان ينفق فيها الاانفقت فيها لك- قال كذبت ولكنك فعلت ليقال هوجواد فقد فيل ثم امربه فسحب على وجهه ثم القى فى النار. (رواه مسلم)
অর্থ:- “ক্বিয়ামতের দিন তিনজন লোককে প্রথমে বিচারের জন্য আনা হবে। প্রথম যে ব্যক্তিকে আনা হবে, সে হলো একজন শহীদ। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে ব্যক্তি তোমাকে আমি এত শক্তি-সামর্থ্য দিলাম, তা দিয়ে তুমি কি করেছ? সে বলবে, আল্লাহ পাক আমি জ্বিহাদ করতে করতে আপনার জন্য শহীদ হয়েছি। আল্লাহ পাক বলবেন, মিথ্যা কথা, তুমি আমার জন্য জ্বিহাদ করনি। মানুষ তোমাকে বড় পালোয়ান বা শক্তিশালী বলবে, সেজন্য তুমি জ্বিহাদ করেছ, যুদ্ধ করেছ। মানুষ তোমাকে শহীদ বলেছে। তখন ফেরেস্তাদের বলবেন, হে ফেরেস্তারা, এ লোকটাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর, তাই করা হবে। দ্বিতীয় আরেকজন লোককে আনা হবে, যাকে ইলম দান করা হয়েছে এবং সে তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। এবং কুরআন শরীফ সহীহ্-শুদ্ধভাবে পড়তে শিখেছে। আল্লাহ পাক তাকে বলবেন, হে আলেম বা ক্বারী সাহেব, তোমাকে এত ইলম দেয়া হয়েছিল, শুদ্ধ করে কুরআন শরীফ পাঠ করতে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, তুমি কি করলে? সে ব্যক্তি বলবে, আল্লাহ পাক, আমি আপনার জন্য ইলম শিক্ষা করেছি এবং তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি, আর আপনার জন্যই আমি কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে পাঠ করেছি। আল্লাহ পাক বলবেন, মিথ্যা কথা। বরং মানুষ তোমাকে বড় আলেম বা বড় ক্বারী সাহেব বলবে, সে জন্যেই তুমি ইলম অর্জন করেছ, কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে শিখেছ। কাজেই মানুষ তোমাকে বড় আলেম, বড় ক্বারী সাহেব বলেছে (তোমার বদলা তুমি পেয়েছ)। তখন আল্লাহ পাক ফেরেস্তাদেরকে বলবেন, হে ফেরেস্তারা, তোমরা এ লোকটাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। তখন তার চুল ধরে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তৃতীয় আরেক জনকে আনা হবে, যাকে অনেক সম্পদ দান করা হয়েছে। তাকে আল্লাহ পাক বলবেন, হে ব্যক্তি, তোমাকে আমি দুনিয়াতে অনেক সম্পদের মালিক করেছিলাম, তার বিণিময়ে তুমি কি আমল করলে? সে ব্যক্তি বলবে, হে আল্লাহ পাক, আমি আপনার পছন্দণীয় এমন কোন পথ নেই, যে পথে দান-খয়রাত করিনি। অর্থাৎ আপনি যতগুলো রাস্তা পছন্দ করতেন॥ মস্জিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা, এতিমখানা, গরীব॥মিস্কিন, রাস্তা॥ঘাট, পুল ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই আমি কম-বেশী দান করেছি। কোন প্রার্থীকে আমি খালিহাতে ফিরিয়ে দেইনি। সবাইকে কম-বেশী দান করেছি, একমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহ পাক বলবেন, মিথ্যা কথা। তুমি এ জন্য করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে, তোমাকে তা বলা হয়েছে। আল্লাহ পাক তখন বলবেন, হে ফেরেস্তারা, এ দানশীল ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দাও। তখন ফেরেস্তারা তাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (মুসলিম শরীফ)
স্মরণীয় যে ইসলামে উনার কাজ বিশেষভাবে যাদের দ্বারা হয় তারা এই তিন শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত।
কারণ জ্বিহাদকারী না হলে ইসলাম জারি রাখা, ইসলামে উনার প্রচার-প্রসার করা এবং ইসলামের শত্রুদের থেকে মুসলমানদের মান-ইজ্জত, আবরু-সম্মান ও সম্পদ ইত্যাদির হিফাযত করা দুরূহ হবে, আলেম না হলে ইল্ম উনার প্রচার-প্রসার হওয়া, মানুষের মাদ্রাসা, মক্তবে ও সাধারণভাবে দ্বীনের তা’লীম পাওয়া, মসজিদ পরিচালনা করা কঠিন হবে এবং দানশীল না থাকলে ইসলামের বহু কাজ যেমন, মসজিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা ইয়াতীমখানা ইত্যাদি হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। অর্থাৎ ইসলামের প্রচার-প্রসারে উপরোক্ত তিন ব্যক্তির অবদান বিশেষভাবে কাম্য। কিন্তু অবদান থাকা সত্ত্বেও উপরোক্ত তিন ব্যক্তি যে কারণে নাযাত পেতে ব্যর্থ হবে তা হলো ইখ্লাছ।
অতএব প্রমাণিত হলো যে, ইখ্লাছ ব্যতীত দ্বীনের দাওয়াত, জ্বিহাদ, দান-খয়রাত ইত্যাদিসহ কোন ইবাদত বা আমলই আল্লাহ পাক উনার নিকট গৃহীত নয়। যদি গ্রহণযোগ্যই হতো, তাহলে হাদীছ শরীফে বর্ণিত তিন প্রকার লোক জাহান্নামী হতোনা।
এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত ইখ্লাছ অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে- ইলমে তাসাউফ। ইলমে তাসাউফ চর্চা বা হাসিল করা ব্যতীত ইখ্লাছ হাছিল করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই শরীয়ত, ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ফরজে আইন করে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে যে,
طلب العلم فريضة على كل مسلم وسلمة. অর্থ:- “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যে ইলমঅর্জন করা ফরজ।” (ইবনে মাজা, বায়হাক্বী)
এ হাদীছশরীফ-উনার ব্যাখ্যায় আরো একখানা হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে যে,
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافح وعلم على للسان فذا لك حجة الله عزوجل على ابن ادم.
অর্থ:- “ইলম দু’প্রকার। একটি হলো- ক্বালবী ইলম, যা উপকারী ইলম অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ। আর দ্বিতীয়টি হলো- জবানী ইলম, যা আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে বান্দার জন্যে দলীলস্বরূপ অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ্।” (দারেমী, মিশকাত)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ইলমে ফিক্বাহের সাথে সাথে ইলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরজে আইনের অন্তর্ভুক্ত। মুলতঃ ইলমে ফিক্বাহের দ্বারা বাহ্যিক আমল পরিশুদ্ধ হবে, আর ইলমে তাসাউফের দ্বারা আভ্যন্তরীণ অর্থাৎ ক্বাল্ব বা অন্তর পরিশুদ্ধ হবে অর্থাৎ ইখ্লাছ পয়দা হবে। বস্তুতঃ আহ্লে তাসাউফ বা অন্তর পরিশুদ্ধকারীগণ অর্থাৎ ইখ্লাছ অর্জনকারীগণই প্রকৃত পক্ষে কামিয়াব বা সফল। আর একমাত্র তাসাউফ চর্চা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমেই প্রকৃত সফলতা অর্জন করা সম্ভব। তাই আল্লাহ পাক বলেন,
قد افلح من تزكى
অর্থ:- “সে ব্যক্তিই কামিয়াবী বা সফলতা অর্জন করেছে, যে ব্যক্তি তায্কিয়া বা পরিশুদ্ধতাঅর্জন করেছে।” (সূরা আ’লা/১৪) মহানআল্লাহ পাক অন্যত্র আরো ইরশাদ ফরমান, قد الفح من زكها وقد خاب من دسها.
অর্থ:- “সে ব্যক্তিই সফলতা অর্জন করেছে, যে ব্যক্তি তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর যে ব্যক্তি তার অন্তরকে কুলষিত করেছে, সে বিফল হয়েছে।” (সূরা শামছ/৯-১০)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ক্বাল্ব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করা বা ইলমে তাসাউফ অর্জন করার মধ্যেই পূর্ণ কামিয়াবী বা সফলতা নিহিত রয়েছে, যা অন্য কোনভাবেই অর্জন করা সম্ভব নয়।